সীতাকুণ্ড ভ্রমণ

 আজ লিখছি সীতাকুণ্ড কোথায় কোথায় কিভাবে ভ্রমন করবেন, কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন, কি কি দেখবেন তার বর্ণনা। আগামিতে লিখব ভ্রমনের পুরা গল্প । 


   সীতাকুণ্ড ভ্রমণ: বাংলাদেশের পাহাড়, ঝর্ণা                         আর সমুদ্রের মিলনস্থল

                                                   প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি
                                                                            লেখক: বাপ্পি 
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------- 
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত সীতাকুণ্ড একটি অসাধারণ পর্যটন স্থান, যেখানে একসাথে পাহাড়, ঝর্ণা এবং সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৩৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই উপজেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবেও পরিচিত। সীতাকুণ্ডের বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, ধর্মীয় গুরুত্ব এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এটিকে বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে।

                                                  চন্দ্রনাথ মন্দির - সীতাকুণ্ডের একটি প্রধান আকর্ষণ

                                সীতাকুণ্ডের প্রধান আকর্ষণ

চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির

সীতাকুণ্ড বাজার থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চন্দ্রনাথ পাহাড় এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। প্রায় ১০২০ ফুট উচ্চ এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, এটি একটি শক্তিপীঠ যেখানে দেবী সতীর ডান হাত পতিত হয়েছিল।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠার জন্য দুটি পথ রয়েছে। ডান দিকের পথটি প্রায় পুরোটাই সিঁড়ি দিয়ে তৈরি, আর বাম দিকের পথটি পাহাড়ি পথ। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য প্রায় ১-১.৫ ঘণ্টা সময় লাগে। চূড়ায় পৌঁছে প্রথমে শ্রী শ্রী বিরূপাক্ষ মন্দির দেখা যায়, এর প্রায় ১৫০ ফুট দূরে চন্দ্রনাথ মন্দির অবস্থিত। পাহাড়ের চূড়া থেকে একদিকে সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য এবং অন্যদিকে পাহাড়ের নির্জনতা উপভোগ করা যায়।

প্রতি বছর শিবরাত্রির দিনে চন্দ্রনাথ মন্দিরে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডে একটি বিশাল মেলা বসে, যাকে শিবরাত্রিদর্শী মেলা বলা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান এবং থাইল্যান্ড থেকে অসংখ্য ভক্ত এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন।

সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক

চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৪০ মিনিটের পথে অবস্থিত সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি আদর্শ স্থান। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ইকোপার্কের আয়তন প্রায় ৮০৮ হেক্টর। এখানে ২৫ মিটার থেকে ৪০০ মিটার উচ্চতার অসংখ্য পাহাড় রয়েছে।

ইকোপার্কের জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে প্রায় ৪১২টি বিদেশী উদ্ভিদ প্রজাতি, ১৫৬টি গাছের প্রজাতি, ১১০টি ঝোপঝাড়, ১১৯টি ভেষজ উদ্ভিদ, ২৭টি লতা এবং বাঁশের প্রজাতি, বিভিন্ন অর্কিড এবং ক্যাকটাস গাছ রয়েছে। এছাড়া এখানে একটি নার্সারি এবং গোলাপের বাগানও রয়েছে।

                                                                                                     সীতাকুণ্ড ইকোপার্কের সহস্রধারা ঝর্ণা

ঝর্ণাসমূহ

সীতাকুণ্ডের আরেকটি প্রধান আকর্ষণ হলো এর অসংখ্য ঝর্ণা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • সহস্রধারা ঝর্ণা: সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে অবস্থিত এই ঝর্ণাটি বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে পানি কম থাকে। বর্ষাকালে এখানে ঝর্ণার পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
  • সুপ্তধারা ঝর্ণা: সহস্রধারা ঝর্ণার কাছেই অবস্থিত এই ঝর্ণাটি পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
  • বড় কমলদহ ঝর্ণা: এটি একটি বিশাল তিন ধাপ বিশিষ্ট ঝর্ণা, যার উচ্চতা প্রায় ১২০-১৪০ ফুট। বর্ষা মৌসুমে এই ঝর্ণার উপরের অংশ বেশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, তাই বর্ষার শেষে এখানে ভ্রমণ করা ভালো।
  • সাগোলকান্দা ঝর্ণা: এটিকে চাগলকান্দা ঝর্ণা বা কমলাক ঝর্ণাও বলা হয়। এটি আসলে একটি ক্যাসকেড বা সিঁড়ি আকৃতির ঝর্ণা।
                                                                                           সহস্রধারা ঝর্ণা - সীতাকুণ্ডের একটি জনপ্রিয় ঝর্ণা

গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত

সীতাকুণ্ড বাজার থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত একটি অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান। স্থানীয়দের কাছে এটি 'মুরাদপুর বিচ' নামে পরিচিত। এই সৈকতের একদিকে সমুদ্রের জল এবং অন্যদিকে কেওড়া বন রয়েছে, যা এটিকে একটি অনন্য রূপ দিয়েছে।

গুলিয়াখালী সৈকতের পরিবেশ স্বাদুপানির জলাভূমি এবং ম্যানগ্রোভ বনের মতো। সৈকতের পাশে বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের মাঠ রয়েছে, যা এই সৈকতকে অন্যান্য সৈকত থেকে আলাদা করেছে। এখানে সমুদ্রের ঢেউ তেমন জোরালো নয়, তাই এটি একটি নিরিবিলি পরিবেশ উপভোগ করার জন্য আদর্শ স্থান।

                                                                                             গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত

সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নে অবস্থিত বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত সীতাকুণ্ড শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে। এটি একটি নিরিবিলি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের সৈকত, যা পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই এই সৈকতের অবস্থান।

মহামায়া হ্রদ

মিরসরাইয়ে অবস্থিত মহামায়া হ্রদ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ। এর আয়তন প্রায় ১১ বর্গ কিলোমিটার। মিরসরাই উপজেলার ৬ নং দুর্গাপুর ইউনিয়নের ঠাকুরডিঘি বাজার থেকে ২ কিলোমিটার পূর্বে পাহাড়ের পাদদেশে এই হ্রদটি নির্মিত হয়েছে।

                                  কিভাবে যাবেন সীতাকুণ্ড

ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ড

  • বাসে: ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে সীতাকুণ্ডে যাওয়া যায়। সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে এস. আলম, শ্যামলী, সৌদিয়া, ইউনিক, হানিফ, ঈগল এবং ইনা সহ বিভিন্ন কোম্পানির এসি/নন-এসি বাস চলাচল করে। নন-এসি বাসের ভাড়া ৪২০-৪৮০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ৮০০-১,১০০ টাকা।
  • ট্রেনে: ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ড মেইল ট্রেনে যাওয়া যায়, ভাড়া জনপ্রতি ১২০ টাকা। অথবা ঢাকা থেকে ফেনী পর্যন্ত আন্তঃনগর ট্রেনে যেতে পারেন, ভাড়া ২৮৫-৬০০ টাকা (শ্রেণীভেদে)। ফেনী থেকে সীতাকুণ্ডের জন্য লোকাল বাসে যাওয়া যায়, ভাড়া ৫০-৬০ টাকা।

চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড

চট্টগ্রামের আলংকার মোড়, একে খান মোড় বা কাদামতলী থেকে সীতাকুণ্ডের জন্য বাস ও মেক্সি পাওয়া যায়। আপনার পছন্দের স্থান থেকে সীতাকুণ্ড বাজারে আসা যায়।

সীতাকুণ্ড থেকে গুলিয়াখালী

সীতাকুণ্ড বাস স্ট্যান্ড ব্রিজ থেকে সরাসরি সিএনজি/অটোতে গুলিয়াখালী বিচ ড্যাম পর্যন্ত যাওয়া যায়। গুলিয়াখালী বিচ ড্যাম পর্যন্ত অটো ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা, এবং রিজার্ভ করলে ১৫০-২০০ টাকা। ভাড়া নির্ধারণের জন্য দরদাম করতে হবে। ফিরে আসার জন্য সিএনজি চালকের নম্বর আগে থেকেই নিয়ে রাখা ভালো।

                                      কোথায় থাকবেন

সীতাকুণ্ডে থাকার জন্য কয়েকটি হোটেল রয়েছে। সীতাকুণ্ড কাঁচা বাজার এলাকা এবং সীতাকুণ্ড থানার কাছাকাছি কিছু মানসম্মত আবাসিক হোটেল রয়েছে, যার মধ্যে হোটেল কমফোর্ট জোন, জলসা, নিউ সৌদিয়া, সৌদিয়া, সাইমন উল্লেখযোগ্য। হোটেল কমফোর্ট জোন, জলসা, নিউ সৌদিয়া তুলনামূলকভাবে নতুন এবং ভালো মানের। এসি ডাবল বেডের রুমের ভাড়া – ১০০০ টাকা এবং নন এসি ৫০০-৬০০ টাকা।

এছাড়া চট্টগ্রাম শহরেও যেকোনো মানের হোটেল বা রেস্তোরাঁ পাওয়া যাবে। চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন মান ও মূল্যের আবাসিক হোটেল ও মোটেলের সুবিধা রয়েছে।

                                               কখন যাবেন

সীতাকুণ্ড ভ্রমণের জন্য শীতকাল (অক্টোবর থেকে মার্চ) সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময় আবহাওয়া অনুকূল থাকে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা সহজ হয়। বর্ষাকালে ঝর্ণাগুলোতে পানি বেশি থাকে, কিন্তু পাহাড়ে উঠার পথ পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

ভ্রমণ টিপস

  • নিরাপদ যাত্রার জন্য প্রয়োজনে পর্যটন পুলিশের সাহায্য নিন।
  • ভ্রমণ এলাকায় আবর্জনা ফেলবেন না বা বর্জ্য না ফেলুন।
  • জোয়ারের সময় জেনে নিন। জোয়ারের সময় সমুদ্র সৈকতের কাছাকাছি না থাকাই ভালো।
  • যেহেতু এটি একটি পর্যটক-বান্ধব সৈকত নয়, সমুদ্রে দূরে যাওয়ার সময় সতর্ক থাকুন।
  • সাঁতার না জানলে কখনই দূরে যাবেন না।
  • পাহাড়ে চড়ার সময় আরামদায়ক জুতো পরুন এবং পর্যাপ্ত পানি সাথে রাখুন।
  • ক্যামেরা, বাইনোকুলার এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সাথে রাখুন।

সীতাকুণ্ড একটি অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান, যেখানে একসাথে পাহাড়, ঝর্ণা এবং সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও অনস্বীকার্য। একদিনের জন্য হোক বা কয়েকদিনের জন্য, সীতাকুণ্ড ভ্রমণ আপনার জন্য এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হবে।



আজ এখানেই শেষ করছি। আগামিতে লিখবো পুরা একটি ভ্রমনের গল্প । আশা করি সাথে থাকবেন। 
ধন্যবাদ সবাইকে । 



Comments

Popular posts from this blog

Travel to Bangladesh in Sitakunda